২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
shadhin kanto

ইউরোপকে যেভাবে ক্ষুধার স্রোতে ভাসাল মহামারি

প্রতিনিধি :
স্বাধীন কণ্ঠ
আপডেট :
ডিসেম্বর ২৮, ২০২০
58
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
ইউরোপকে যেভাবে ক্ষুধার স্রোতে ভাসাল মহামারি
| ছবি : ইউরোপকে যেভাবে ক্ষুধার স্রোতে ভাসাল মহামারি

করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার আগেও জীবন খুব একটা সহজ ছিল না প্যাট্রিসিয়ার। সঙ্গীর নিপীড়নে টিকতে না পেরে সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে সন্তানদের নিয়ে অনেকটা এক কাপড়েই পূর্ব লন্ডনের একটি ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠেন। জীবিকার তাড়নায় গত কয়েক বছর একটি কফিশপের কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন এ নারী। কিন্তু সেই সুখও(!) বেশিদিন টিকল না। মহামারি ছড়িয়ে পড়তেই লকডাউন হয়ে যায় গোটা যুক্তরাজ্য। ফলে সাময়িক ছুটিতে যেতে হয় প্যাট্রিসিয়াকে। অর্থের টানাটানি চরমে পৌঁছালে একপর্যায়ে আবিষ্কার করেন, সন্তানদের মুখে খাবার জোটাতে একটি ফুড ব্যাংকের সাহায্য নিতে হচ্ছে তাকে।

প্যাট্রিসিয়া বলেন, সন্তানদের এটা বোঝানো কঠিন যে, আপনি কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তারা দরিদ্রতা বোঝে না।

তিনি বলেন, জানি না এটা কীভাবে বর্ণনা করব। তখন সাহায্য না পেলে হয়তো একটা কোণায় পড়ে যেতাম। মানসিকভাবে এটা আমাকে পুরো অন্য জায়গায় নিয়ে যেত।

ব্রিটিশ রাজধানীর অন্যতম উপেক্ষিত এলাকা টাওয়ার হ্যামলেটের আরও অনেকের মতো প্যাট্রিসিয়াও খাদ্য সহায়তার জন্য ‘ফার্স্ট লাভ ফাউন্ডেশন’-এর দ্বারস্থ হন। দাতব্য সংস্থাটি শুধু খাবারই নয়, দরিদ্রদের আবাসন এবং আইনি সহায়তাও দিয়ে থাকে।

ফার্স্ট লাভ ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, যুক্তরাজ্যে মহামারির প্রথম পর্যায়েই তাদের খাদ্য সহায়তার চাহিদা ৯২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা ডেনিস বেন্টলি বলেন, যখন করোনা আসতে দেখলাম, আমাদের জন্য খেলা পুরো বদলে গেল। তার কথায়, যুক্তরাজ্যে, বিশেষ করে টাওয়ার হ্যামলেটে আগে থেকেই খাদ্য সংকটে ভুগতে থাকা অনেকের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে এই মহামারি।

ক্রমবর্ধমান সংকট

করোনাভাইরাস মহামারি ক্রমবর্ধমান ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য আরও তীব্র করে তুলেছে। গত জুলাইয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেয়েরেস বলেছিলেন, ভাইরাসটি গত কয়েক দশকের ঝুঁকি ও অসমতাগুলোর চেহারা উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এই অঞ্চলে এতদিন যারা দারিদ্র্যদূরীকরণ এবং বৈষম্য নির্মূলে অগ্রগতি দেখাচ্ছিল, তারা মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বহু বছর পেছনে ফিরে গেছে।

অবশ্য ইউরোপে বিশ্বের বেশ কিছু ধনীতম এবং সর্বাধিক উদার সামাজিক সুরক্ষা নীতি সম্পন্ন দেশেই করোনা সংকটের আগে থেকে ক্ষুধা ও বঞ্চনার অস্তিত্ব ছিল।

ইউরোস্ট্যাটের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ৯ কোটি ২৪ লাখ মানুষ, অর্থাৎ এ অঞ্চলের মোট জনগোষ্ঠীর ২১ দশমিক ১ শতাংশই দারিদ্র্য বা সামাজিক বঞ্চনার ভুক্তভোগী ছিলেন।

২০১৮ সালে সংস্থাটির আরেক পরিসংখ্যান বলছে, ইউরোপের ৩ কোটি ৩৪ লাখ মানুষ একদিন পরপর মাছ, মাংস বা শাক-সবজির মতো পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে না।

এর মধ্যে বৈশ্বিক মহামারির আঘাতে অবস্থা আরও করুণ হয়ে উঠেছে। ইউরোপের বড় বড় শহরগুলোতে খাদ্য সংকটে ভুক্তভোগী এবং ফুড ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় ফুড ব্যাংক নেটওয়ার্ক ট্রাসেল ট্রাস্ট জানিয়েছে, মহামারির প্রথম ধাপে এবং গত ৭০ বছরের মধ্যে প্রথমবার তাদের চাহিদা একলাফে ৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সংকট কাটাতে ইউনিসেফও দেশটির ক্ষুধার্ত শিশুদের সাহায্য করার ঘোষণা দিয়েছে।

সংকটের আরও বিশদ চিত্র দেখা যায় ইউরোপীয় ফুড ব্যাংক ফেডারেশনের (এফইবিএ) তথ্যে। সংস্থাটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইউরোপে তাদের ৪৩০টি ফুড ব্যাংকে প্রায় ৩০ শতাংশ চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাপূর্ব সময়ের তুলনায় দেশভেদে এই চাহিদা বৃদ্ধির পরিমাণ ৬ থেকে ৯০ শতাংশ।

এফইবিএ’র সভাপতি জ্যাক ভ্যান্ডেনশ্রিক বলেন, সহায়তা কর্মসূচিতে অনেক সময় ইইউ দেশগুলোকে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ধরলেও বেশ কিছু সরকারের রেখে যাওয়া খাদ ফুড ব্যাংকগুলোকে পূরণ করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা এমন একটা কাজ করি, কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক দেশে যার কোনও অস্তিত্ব নেই। কারণ, সেখানে ফুড ব্যাংকের প্রয়োজন হয় না, রাষ্ট্রই সব সরবরাহ করে।

ভ্যান্ডেনশ্রিক বলেন, যেখানে কাউকে খাদ্য সহায়তার প্রয়োজন হয় না, যেখানে খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা নেই, সেখানে ফুড ব্যাংকগুলোও অদৃশ্য হয়ে যায়। এটা অর্জন করতে আমাদের খাদ্য উৎপাদন, খাদ্যাভ্যাস এবং খাদ্য কীভাবে বিতরণ হচ্ছে তার গোটা ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া দরকার।

খাদ্য দরিদ্র্যতার প্রভাব
কঠিন বাস্তবতা হলো- ইউরোপজুড়ে অনেকেই এখন ফুড ব্যাংকের সহায়তা নেওয়া থেকে মাত্র বেতনের দু’টি চেক না পাওয়া অথবা একটা বড় আঘাতের দূরত্বে রয়েছেন।

ফরাসি ফুড ব্যাংক রেস্তোঁ দু কোয়েরের সভাপতি প্যাট্রিস ব্ল্যাঙ্ক বলেন, এটা যে কারও সঙ্গেই হতে পারে।

তিনি জানান, মহামারির কারণে ফ্রান্সে ক্ষুধার স্রোত শুরু হওয়ায় চলতি বছর তাদের ফুড ব্যাংকের চাহিদা প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ভুগছে প্যারিসের উত্তরাঞ্চলীয় শহরতলীগুলো। সেখানে প্রতিদিন শত শত লোক খাবারের সন্ধানে হাজির হচ্ছেন।

ব্ল্যাঙ্ক বলেন, এর জন্য তারা (দরিদ্র) নয়, লজ্জিত হওয়া উচিত সমাজের। তার কথায়, লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই ফুড ব্যাংক থেকে সাহায্য নিতে আসতে পারেন না।

রেস্তোঁ দু কোয়েরের প্রধান বলেন, ফুড ব্যাংক শুধু খাবারই দেয় না, এটা সামাজিক সম্পর্কও নিশ্চিত করে। দারিদ্র্য শুধু আয়ের প্রশ্ন নয়, এটা একাকিত্বের প্রশ্ন, একাকিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্ন।

অনেকটা একই কথা বলেছেন জার্মান ফুড ব্যাংক তাফেল ডয়েচল্যান্ডের চেয়ারম্যান জোশেন ব্রল। ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশেও তার সংস্থা অন্তত ১৬ লাখ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে।

ব্রল বলেন, দারিদ্র্যের হুমকিতে থাকা বা এতে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকের মধ্যেই নিঃসঙ্গতা ও মানসিক চাপ রয়েছে। আমরা বহু বছর ধরে রাজনীতিবিদ এবং সমাজকে বোঝাতে চাচ্ছি যে, দারিদ্র্যদূরীকরণ তাফলের কাজ নয়। আমাদের কাজ বা আমরা অন্তত এটাকে যেভাবে দেখছি, তা হলো- জনগণকে সহায়তা করা।

তার কথায়, রাজনীতি এবং সমাজকে দারিদ্র্যের বিষয়টিকে এজেন্ডা হিসেবে রাখার চেয়েও বেশি কিছু করা দরকার। আর করোনার মধ্যে বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

গরম খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram