ঝালকাঠিতে শুকনো মৌসূমে ঘুড়িতে মাতছে শিশু-কিশোর
এ রহমান, ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ পড়ন্ত বিকাল। দোকানে বসে গভীর মনোযোগে ঘুড়ি তৈরী করছেন নাসির মিয়া। প্রতি পিচ ঘুড়ি ১০ টাকায় বিক্রি করেন। বিকেল হলেই শিশু কিশোরের দল তাঁর দোকানে ঘুড়ি কিনতে ভিড় করে। ক্রেতার চাহিদামতো ঘুড়ি বানানোয় যেন দম ফেলার ফুরসত নেই বাবা তার। গোধূলি নামার আগে নিজের হাতে বানানো ঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে দেখালেন নাসির মিয়া।
গগনে কয়েক শ ফুট উঁচুতে থলের মতো বসে গেলে ঘুড়িটি। আর ডেনুর ‘পত পত’ শব্দে মুগ্ধ ওই এলাকার শিশু-কিশোরসহ সব বয়সী মানুষ। ঝালকাঠি আড়দ্দার পট্টি এলাকার নাসির মিয়া এভাবেই ঘুড়ির কারুকাজে শিশু-কিশোরদের কাছে এখন প্রিয় নাসির কাকা। গাঁও গেরামে ডাকা এই ‘ঘুট্টি’ বিক্রি করে একদিকে বাড়তি আয় অপরদিকে মনের খোরাকি যোগাচ্ছেন নাসির মিয়া।
আরওপড়ুন>>>সংক্রমণ বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত: শিক্ষামন্ত্রী
ঘুড়ির কারিগর নাসির মিয়া জানান, রোজ ১৫/২০টি ঘুড়ি বিক্রি হয়। কোনো দিন আরো বেশি বিক্রিও হয়। এতে তার সংসারে বেশ উপড়ি আয় হয়। দূর-দূরান্তর থেকে জজ মিয়ার বাড়ি আসে শখের হরেক রকমের ঘুড়ি কিনতে। অনেকে আবার ঘুড়ি ছেলেমেয়ের জন্য কিনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন।
আড়দ্দার পট্টি এলাকার নাসির মিয়ার ঘুড়ির নেশাটা ছোটবেলা থেকে। নিজের তৈরি ঘুড়ি গাঙের পাশে অথবা খোলা মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করে উড়াতেন। ঘুড়ি পিছনে পড়ে থাকায় অভাবের পরিবারে মায়ের বকুনিও খেয়েছেন। সেই ঘুড়ি এখন তার উপার্জনের একটি উপায়। ঘুড়ি বানানোর নেশা যেন সাময়িক পেশায় বনে গেল চল্লিশোর্ধ নাসির মিয়ার।
শুকনো মৌসুম শুরু হলেই শহর ও গ্রামাঞ্চলে ঘুড়ির উৎসব শুরু হয়। মাঘ মাস থেকে শুরু হয়ে পরের ৪ মাস পাখির আকাশে থাকে ঘুড়ির রাজত্ব। বাতাসের তালে তালে খোলা আকাশে আপন ঢংয়ে উড়ে ঘুড়ি। ঘরোয়াভাবেই ধুম বিক্রি হচ্ছে ঘুড়ি। নাটাইয়ের সুতা ছিঁড়ে ঘুড়ি চলে যাচ্ছে এক গ্রামে।
যদিও ঘুড়ির কোনো গন্ডি নেই। অনেক সময় এক ঘুড়ি অন্য ঘুড়ির সুতা কাটে। যা সবাইকে ভিন্ন মনোরঞ্জন করে তোলে। এর জন্য কাচের গুঁড়ো, আঠা ইত্যাদি মিশ্রিত বিশেষ মশলা যা সুতায় মাখিয়ে রোদে শুকানো হয়। যাকে বলে মাঞ্জা দেওয়া।
ঘুড়ির কারিগর নাসির মিয়া জানান, একটি পরিপাটি ঘুড়ি বানাতে বেশ শ্রম ও যত্ন দিতে হয়। ঘুড়ি তৈরীতে সময়ও লাগে মনোযোগ দিয়ে মেরামত করতে। উপাদান ভালো হলে নকশার কারুকাজ সুচারু হয়। প্রথমে কাঁচা বাঁশ কেটে চিকন কঞ্চি করতে হয়। গ্রামের ভাষায় যাকে বলে এক ধরনের ‘হলি’ বলা হয়। ঘুড়ির প্রকার অনুয়ায়ী শলাগুলো বিভিন্ন আকৃতিতে সাজিয়ে সবুজ হলুদ পোস্টার কাগজ দিয়ে ছাউনি দিতে হয়। গ্রামে এটি ‘কাঠ কাগজ’ বলে পরিচিত। কিন্তু ইদানীং বৃষ্টি বেশি হওয়ায় মোটা পিলিথিন দিয়ে ছাউনি দিতে হচ্ছে।
নাসির মিয়া আরো বলেন, আমার কাছে ঘুড়ি কেনার জন্য শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সি মানুষ সিরিয়াল ধরেন। অনেক সময় কাজের চাপ খুব থাকে। অন্য কাজ না করে ঘুড়ি বানাতে হয়।
তিনি জানান, ঘুড়ির সাইজ অনুয়ায়ী দাম কমবেশি হয়। শূন্যে বেশি উড়লে দাম ভালো পাওয়া যায়। ডেনুর ‘শোঁ শোঁ’ বেশি হলে সবাই কিনতে চায়। তাদের ঘুড়ি অনেকে শখ করে ঢাকায় নিয়ে যায়। ঈদে গ্রামে বেড়াতে এসে কিনে নিয়ে যায়। ঘুড়ি অনেক ধরনের হয়ে থাকে। একেকটার কাজ একেক রকম। কোনোটায় পরিশ্রমও বেশি।
ঘুড়ির মধ্যে জনপ্রিয় হলো ঢাউস, ঢুলি, তেলেঙ্গা, চিল, সাপ, ধারি ও ফুল ঘুড়ি। এ ছাড়াও আছে চারকোনা আকৃতির বাংলা ঘুড়ি, ড্রাগন, বক্স, মাছরাঙা, ঈগল, ডলফিন, অক্টোপাস, সাপ, ব্যাঙ, মৌচাক, কামরাঙা, আগুন পাখি, প্যাঁচা, ফিনিক্স, জেমিনি, চরকি লেজ, পাল তোলা জাহাজ, জাতীয় পতাকা প্রমুখ।
নার্সারি পড়ুয়া ছেলের জন্য দুইটি ঘুড়ি কিনেছেন আশরাফ উদ্দিন আসিফ ও আলী আহমেদ আশিক। তারা বলেন, নাসির মিয়া ছোটকাল থেকে ঘুড়ি বানান। বিক্রিও করেন। তার ঘুড়ি উড়ে ভালো। আমরাও ছোট সময় উড়াতাম। মজাই আলাদা। এখন উনার ঘুড়ি আমাদের বাচ্চারাও উড়াবে। গুনগুন শব্দে মুগ্ধ হবে।