দক্ষিণাঞ্চলের বাতিঘর অনির্বাণ লাইব্রেরী
পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি : একটি ভবন, কিছু আলমারি ও আসবাবপত্র কিংবা কিছু পাঠক মানেই লাইব্রেরী নয় সেটি প্রমাণ করেছেন খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী মাহমুদকাটী অনির্বাণ লাইব্রেরী।
অনির্বাণ লাইব্রেরী মানেই দক্ষিণাঞ্চলের বাতিঘর
অনির্বাণ লাইব্রেরী মানেই একটি সামাজিক আন্দোলন, অনির্বাণ লাইব্রেরী মানেই সেবামূলক একটি প্রতিষ্ঠান, অনির্বাণ লাইব্রেরী মানেই দক্ষিণাঞ্চলের বাতিঘর।
পাঠাগার কেন্দ্রিক লাইব্রেরীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজ উন্নয়ন মূলক বহুমূখী কর্মকান্ডের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার এ লাইব্রেরীটি এখন
দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছে।
মাহমুদকাটী গ্রামের কৃতি সন্তান ও বর্তমান সিলেট রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি জয়দেব ভদ্র পরিবার পরিজনের জন্য বাড়ি-গাড়ি করার কথা না ভেবে অবহেলিত নিজ এলাকার জনপথকে বদলে দিতে এলাকার কয়েকজন যুবককে সাথে নিয়ে ১৯৯০ সালে নিজ গ্রামেই গড়ে তোলেন অনির্বাণ লাইব্রেরী।
১১ শতাংশ জমির ওপর ৪ তলা ফাউন্ডেশনের ৩ তলা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক লাইব্রেরী ভবন করা হয়েছে।
ভবনের প্রথম ফোরে আড়াই’শ দর্শনার্থী ধারণ ক্ষমতা বিশিষ্ট হল রুম রয়েছে।
দ্বিতীয় তলায় লাইব্রেরী রুম কম্পিউটার ল্যাব ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের জন্য দুইটি পৃথক রিডিং রুম, কমন ড্রইং রুম এবং বাথরুম সহ দুটি অতিথি কক্ষ রয়েছে।
ভবনের তৃতীয় তলায় লাইব্রেরী সহ ৫টি গেস্ট রুম রয়েছে। লাইব্রেরীতে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান লেখকদের লেখা ৭ হাজার বই ও বরেণ্য ব্যক্তিদের ছবি সংগৃহিত রয়েছে।
গত ৩ দশকে অনির্বাণ লাইব্রেরী বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে
লাইব্রেরীর মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নমূলক নানামূখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। লাইব্রেরীর কর্মকান্ডে প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসূচি। লাইব্রেরীতে একজন অবসর প্রাপ্ত চিকিৎসক দ্বারা ফ্রি ফ্রাইডে কিনিক পরিচালিত হয়।
এর মাধ্যমে এলাকার অতিদরিদ্র ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ঔষধ প্রদান করা হয়। গরীব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মনির উদ্দীন ও নীরসাগর অনির্বাণ বৃত্তি প্রদান করা হয়। মাহমুদকাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দুই সেট স্কুল পোশাক দেওয়া হয়।
অনির্বাণের স্বেচ্ছাসেবকদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বীকরার জন্য ব্লাক-বেঙ্গল জাতের একটি ছাগলের খামার ও পুকুরে সমন্বিত হাঁস ও মাছ চাষের প্রকল্প রয়েছে। বিধবা নারীদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষে সেলাই মেশিন বিতরণ, ছাগল ও হাঁস-মুরগী পালনে বিশেষ প্রকল্প চলমান রয়েছে। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে মানবিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
এলাকায় পাখির অভায়াশ্রম গড়ে তুলতে পৃথক ৩টি স্থানে ৩ হাজার মাটির পাত্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব স্থানে পাখিদের খাবারও সরবরাহ করা হয়। বৃক্ষরোপন ও শীতবস্ত্র বিতরণ সহ বিভিন্ন মানবিক কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ছাত্র ও যুবকদের জন্য ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ কাব চালু করা হয়েছে। সপ্তাহে ২ দিন শিশু একাডেমীর আদলে শিশুদেরকে ছবি আঁকা, নাচ এবং গানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
অনির্বাণ ব্লাড ফর লাইফ
অনির্বাণের দেড়’শ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে স্বেচ্ছায় রক্ত দান সংগঠন “অনির্বাণ ব্লাড ফর লাইফ” গঠন করা হয়েছে। পর্যটকদের জন্য কপোতাক্ষ নদে মাঝারি মানের টুরিস্ট বোট তৈরীর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আম্পানে এলাকার ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে ৩০ লক্ষ টাকার খাদ্য, গৃহ নির্মাণ সামগ্রী ও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এলাকার গন্ডি পেরিয়ে দেশের ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগরে টর্নেডোয় ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝেও অনির্বাণের পক্ষ থেকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।
গার্মেন্টস শ্রমিকের অগ্নিদগ্ধ, ৫ বছরের শিশু মারিয়া ও হবিগঞ্জ, শায়েস্থাগঞ্জের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রী নদীর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে অনির্বাণ লাইব্রেরী।
আমাকে বাইসাইকেল দিয়ে বাবার কথা রেখেছে অনির্বাণ লাইব্রেরী
সম্প্রতি ৩ জেলার ৮টি উপজেলার গরীব ও মেধাবী ছাত্রীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে বাইসাইকেল। শিক্ষার্থী মাসুমা আক্তার নিশা জানান, আমার বাবা বলেছিল এসএসসি’তে এ প্লাস পেলে বাইসাইকেল কিনে দিবে। আমি এ প্লাস পেয়েছিলাম, দারিদ্রতার কারণে আমার বাবা কথা রাখতে পারেনি। আমাকে বাইসাইকেল দিয়ে বাবার কথা রেখেছে অনির্বাণ লাইব্রেরী।
অনলাইন ও প্রিন্ট আকারে অনির্বাণ সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে মেধা এবং মানসিক বিকাশ ঘটছে বলে শিব্সা সাহিত্য অঙ্গনের সভাপতি সুরাইয়া বানু ডলি জানান। প্রতিষ্ঠানটিতে দাতা, আজীবন ও সাধারণ সদস্য ক্যাটাগরির সদস্য রয়েছে। কার্যকরী কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের তত্বাবধায়নে অনির্বাণ লাইব্রেরীর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ কাজে অনির্বাণ ছাত্র সংসদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
লাইব্রেরীর ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত রয়েছেন দেশ-বিদেশের ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পৃথক পৃথক সাব কমিটি রয়েছে বলে লাইব্রেরীর সাধারণ সম্পাদক প্রভাত দেবনাথ জানান। নানামূখী এ সব কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করেছে অনির্বাণ লাইব্রেরী।
সরকারের একাধিক মন্ত্রী, সচিব, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও শিল্পপতিরা ইতোমধ্যে লাইব্রেরীর কার্যক্রম পরিদর্শন করে ভূয়সী প্রসংশা করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি নানামূখী কর্মকান্ডের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের বাতিঘর হিসেবে অত্র অঞ্চলকে আলোকিত করছে।
লাইব্রেরীর সভাপতি অধ্যাপক কালিদাশ চন্দ্র জানান, মানবিক তৎপরতা জোরদার করার পাশাপাশি সারাদেশে লাইব্রেরী আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষে অনির্বাণ লাইব্রেরী নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।