শেষ সম্বলটুকু রেখে যেতে চান একটি স্কুলের জন্য: দিল আফরোজ খুকি
দিল আফরোজ খুকি । সূর্য উঠার আগেই রাজশাহী শহরের রেলওয়ে মার্কেটের দিকে ধীর পায়ে খুকির এগিয়ে
চলা। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর সার্কুলেশন অফিস ও সংবাদপত্রের এজেন্ট অফিস থেকে সংবাদপত্র সংগ্রহ করেন।
এরপর হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন বাড়ি ও মোড়ে সংবাদপত্র বিক্রি করে বিকেলে আবার বাড়িতে ফিরে আসেন।
দীল আফরোজ খুকির জীবিকা নির্বাহের একমাত্র সম্বল পত্রিকা বিক্রি করা। প্রায় ৪০ বছর ধরে সকাল থেকে
সন্ধ্যা পর্যন্ত পায়ে হেঁটে রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সংবাদপত্র বিক্রি করেন তিনি। শহরের একমাত্র নারী
সংবাদপত্র বিক্রেতাও তিনি।
অল্প বয়সেই ৭০ বছরের এক বৃদ্ধের সঙ্গে খুকির বিয়ে হয়েছিল। এক মাস না যেতেই স্বামী মারা যান।
১৯৮০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবার আত্মীয় স্বজন তাকে ঘর ছাড়া করেন। ভাইদের আপত্তিতে বাবার
বাড়িতেও খুকির জায়গা হয়নি। এরপর থেকেই কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি।
পাগলী বলে তাকে কেউ আশ্রয়ও দেয় না। এমনকি অনেকে মারধরও করে। তবুও কারো উপর নির্ভরশীল না হয়ে বেছে নেন পত্রিকা বিক্রির পেশা।
বড় কোনো সমস্যা তাকে কাবু করতে না পারলেও মাঝমধ্যে ছোটখাটো সমস্যাগুলো তাকে অসহায় করে দেয়।
এরপরো কোনো লোভ-লালসা নেই খুকির। একদিন একটি মানিব্যাগ কুড়িয়ে পান খুকি। মানিব্যাগের মালিককে
তা ফিরিয়ে দিলে তাকে ১৫০ টাকা বকশিস দেন। সেদিন খুকি সবাইকে বলেছিলেন, ‘আমি সবার চেয়ে ধনী।’
দিল আফরোজ খুকির সংগ্রামী পথচলা
মানষিক ভারসাম্যহীনতা এখন অনেকটাই চলে গেছেন। মানুষ এখন আর তাকে দেখলে গালাগালি করে না
এখন অনেকটাই শান্ত হয়ে এলোমেলো কথা বলেন খুকি। এরই ফাঁকে খুকি স্বাধীন কণ্ঠকে জানান, স্থানীয় ও
জাতীয় দৈনিকসহ প্রতিদিন ৩০০ পত্রিকা তিনি বিক্রি করেন। এ থেকে প্রতিদিন তার আয় প্রায় ৩০০ টাকার মত হয়।
এই টাকা থেকে নিজের খরচ মাত্র ৪০ টাকা। আগে জমানো টাকা থেকে আগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দিলেও এখন আয় কমে যাওয়ায়, সেই সুযোগ অনেকটাই কমে গেছে। নিজেই চলেন কষ্ট করে।
প্রতিদিন সকালে তার শিরোইল মহল্লার বাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে রাজশাহী মহানগরীর রেলগেট মার্কেটে
পত্রিকার এজেন্টদের কাছ থেকে পত্রিকা ক্রয় করেন। তারপর সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে রাজশাহীর
রেলস্টেশন, শিরোইল বাস টার্মিনাল, সাগরপাড়া, আলুপট্টি, সাহেব বাজার, আরডিএ মার্কেট ও নিউ মার্কেটে
পত্রিকা বিক্রি করেন। এইসব স্থানে তার কিছু নিয়মিত কাস্টমার আছে তাদের কাছে পত্রিকা বিক্রি করেন
আবার সড়কে চলাচল করা বা বাজারে কেনাবেচা করতে আসা মানুষদের কাছে নিয়ে গিয়েও পত্রিকা কিনতে
অনুরোধ করেন। এদের মধ্যে অনেকে পত্রিকা নেন আবার অনেকে পত্রিকা নেন না। তবে পত্রিকা বিক্রির
বিনিময়ে তিনি কখনো অতিরিক্ত কোনো টাকা পয়সা নেন না।
দিল আফরোজ খুকি বলেন, আগে বেশি পত্রিকা বিক্রি হতো। লোকজনের কাছে গেলে পত্রিকা নিতো। এখন কম পত্রিকা বিক্রি হয়। লোকজন তেমন পত্রিকা কিনতে চায় না।’ তারপরও আমৃত্য এই পেশার সঙ্গে থেকেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান তিনি।
রাজশাহীর স্থানীয় পত্রিকার সার্কুলেশন ম্যানেজার লিটন ইসলাম বাবু জানান, ‘আমি ১৩ বছর ধরে খুকি আপাকে দেখছি আমার কাছ থেকে পত্রিকা নিতে। কখনো কোনো বকেয়া রাখেননি। আগে টাকা পরিশোধ করেন, তারপর পত্রিকা কিনেন। দুই তিন বছর আগেও পত্রিকা নিতো একশো কপির মতো। এখন কখনো তিরিশ কপি কখনো ২০ কপি নেন।’ আরেকটি দৈনিকের সার্কুলেশন ম্যানেজার হারুন জানান, টাকা পয়সা পরিশোধ করেই তারপর পত্রিকা কিনেন খুকি। তার পত্রিকাও আগে দেড়শো কপির মতো কিনলেও বর্তমানে ৩০ থেকে ৫০ কপির মতো কিনেন বলেন জানান তিনি।
দিল আফরোজ খুকি সম্পর্কে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশিরা কি বলছেন?
তবে খুকির পরিচিত আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশিরা বলছেন, কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন এই নিঃসন্তান নারী। তার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে আরও একগুয়ে স্বভাবের হয়ে উঠেন তিনি। বাবার কাছ থেকে পাওয়া জমিতে বাড়ি তৈরি করে একাই থাকেন। কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা নেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে পত্রিকা বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন।
একই মহল্লার সত্তরোর্ধ্ব আব্দুল কাদির বলেন, ‘আমার ছোট বোনের বান্ধবী খুকি। বিয়ের পর স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই সে কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপর থেকে তাকে পত্রিকা বিক্রি করতে দেখি। আমিও তার নিয়মিত গ্রাহক। প্রতিদিন সকালে আমাকে পত্রিকা দিয়ে যায়।’
দিল আফরোজ খুকি’র বড় বোনের বাড়ি তার বাড়ির পাশেই। তার বড় বোনের ছেলে শামস উর রহমান বলেন, ‘খালা বহু বছর ধরে পত্রিকা বিক্রির সঙ্গে জড়িত। তাকে নিষেধ করা হলেও শুনেন না।’
খুকি তার শেষ সম্বলটুকু রেখে যেতে চান একটি স্কুলের জন্য। যে স্কুলের প্রথম ও দ্বিতীয় হওয়া শিক্ষার্থীরা তার টাকা থেকে বৃত্তি পাবে। মৃত্যুর পর এই জগতের শেষ ঠিকানা করতে চান জন্ম শহর কুষ্টিয়ায়।
দিল আফরোজ খুকি /স্বাধীন কণ্ঠ
আরো পড়ুন:
আনিসুল করিম শিপন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার ১০ জন
নতুন দায়িত্বে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম
যশোরের বেনাপোলে জাল নোটসহ মহিলা আটক
অবৈধ ভাবে ভারত যাওয়ার পথে চারজন নারীসহ পাঁচজন আটক
শীতের আগমনে শার্শার গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুরের রস সংগ্রহে ব্যস্ত গাছিরা
শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঘোড়া ও কুকুর উপহার দিলো ভারতীয় সেনাবাহিনী