২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
shadhin kanto

সকালের তাজা পেয়ারা ঢাকায় যাচ্ছে দুপুর ৩টার মধ্যেই

প্রতিনিধি :
স্বাধীন কণ্ঠ
আপডেট :
জুলাই ২৯, ২০২২
60
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন আমরা
ঝালকাঠির ভীমরুলীর ভাসমান হাট থেকে পেয়ারা কিনে ঢাকার উদ্দেশ্যে ট্রাকে লোড করা হচ্ছে। | ছবি : পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন আমরা

এ রহমান, ঝালকাঠিঃ ঝালকাঠি সদর উপজেলার কির্ত্তিপাশা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের কৃষক পঙ্কজ বড়াল ৩বিঘা জমি লিজ নিয়ে সেখানে কাঁদি কেটে বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করেন তিনি। সেখানে পেয়ারা, আমড়া, লেবু, কলা, কচু, ঝিঙা, ছিচিঙা, পাটশাক, পুই শাক, কুমড়াসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষিকাজ করেন তিনি। রাসায়নিক ও জৈবসার দিয়ে আবাদি কৃষিতেও বেশ ভালো ফলন পেয়েছেন তিনি।

ঝালকাঠির ভীমরুলীতে ভাসমান পেয়ারার হাট

এখন পেয়ারা ও বর্ষাকালীন সবজির ভরা মৌসুম। প্রতিদিন সকালে তার আবাদকৃত পেয়ারা বাগান থেকে ৩/৪মন পেয়ারা সংগ্রহ করেন। সকাল ৯টার মধ্যেই ঝালকাঠি পেয়ারার সবচেয়ে বড় মোকাম ভীমরুলী ভাসমান হাটে নৌকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যান। সেখানে পাইকারদের কাছে প্রতিকেজি পেয়ারা ২০টাকা দরে বিক্রি করেন। আগের চেয়ে বেশি দামে পেয়ারা বিক্রি করতে পেরে তিনি বেজায় খুশি।

আরও পড়ুন>>>যশোরে শিশু ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে একজনের মৃত্যুদণ্ড

পাইকার আবুল বাশার শুক্রবার সকালে পঙ্কজ বড়ালসহ অন্যান্য কৃষকদের কাছ থেকে পেয়ারা কিনে প্যাকেজ করে দুপুর ১২টার দিকে এক ট্রাক পেয়ারা ঢাকায় পাঠান। ট্রাকটি দুপুর ৩টার মধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে পৌঁছে যায়। ঢাকার আড়তদারদের মাধ্যমে বিকেলের মধ্যেই তা খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে হাতে পৌঁছে গেছে। সেদিনই তাজা পেয়ারার স্বাদ নিতে পেরেছেন রাজধানীবাসী।

পদ্মা সেতুর সুবাদে কৃষক পঙ্কজ বড়াল ন্যায্য দামে পাইকার আবুল বাশারের কাছে বিক্রি করতে পেরেছেন। আবার পাইকাররাও একটু বেশি দামে পেয়ারা কিনলেও ৪ঘন্টার মধ্যেই ঢাকায় পৌছাতে পেরে তাজা পেয়ারা ভালো দামে আড়তে বিক্রি করতে পারছেন। খুচরা বিক্রেতারাও ক্রেতাদের কাছে তাজা পেয়ারা পৌছে দিয়ে প্রতি কেজি ৫০টাকা করে রাখছেন। শুধু আবুল বাশারই নন অনেক আড়তদারের পেয়ারার ট্রাক প্রতিদিন দুপুরে ৩টার মধ্যেই ঢাকা শহরে পৌঁছাচ্ছে। গত মৌসুম পর্যন্ত বাগান থেকে তোলার পরদিন এখানকার পেয়ারা পৌঁছাত রাজধানীতে। পেয়ারা চাষীরাও প্রতিকেজি ১০টাকা বা তার কমেও পাইকারদের কাছে পেয়ারা বিক্রি করতেন।

পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলে কৃষিপণ্যের প্রথম সুফলভোগী হলেন পেয়ারাচাষীরা। ঝালকাঠি সদর উপজেলা, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি ও বরিশালের বানারিপাড়া উপজেলার ৫৫ গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে মিষ্টি পেয়ারা রাজ্য। প্রতিবছর আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস এলেই পেয়ারার কারণে পাল্টে যায় ওই অঞ্চলের চিত্র। পেয়ারা বেচাবিক্রির জন্য ওইসব এলাকার খালে রয়েছে ভাসমান বাজার। প্রতিদিন শত শত নৌকায় চাষীরা আসে পেয়ারা বিক্রি করতে। ট্রাক ও বড় বড় ট্রলার নিয়ে আসেন পাইকাররা পেয়ারা কিনতে। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ায় আরিচা ফেরিঘাটের বিড়ম্বনা না থাকায় পাইকার ও পর্যটকদের আগমন প্রতিবছরের চেয়ে এবছর বেশি। ফলে এ অঞ্চলের শুধু পেয়ারাই নয় অন্যান্য কৃষি পণ্যও ঢাকাসহ সারাদেশে অল্প সময়ে সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে।

ঝালকাঠির শহর থেকে কীর্তিপাশা হয়ে সরু সড়ক ধরে এগিয়ে গেলেই বিখ্যাত ভীমরুলী বাজার। খালের পাড় ঘেঁষে বিখ্যাত ভাসমান বাজারে যেতে যেতে চোখ প্রশান্ত করবে চিরায়ত গ্রাম-বাংলার মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য। যদিও এক সময়ের মেঠোপথ এখন পিচঢালা পাকা সড়ক। ঝালকাঠি শহর থেকেই মোটর সাইকেল, অটো রিক্সা, মাহিন্দ্রা ও লেগুনা যোগে মাত্র ৩০ মিনিটেই পৌঁছানো যায় ভীমরুলী বাজারে। প্রাকৃতিক অপূর্ব দৃশ্য ও ভাসমান বাজার উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ভ্রমণ পিপাসুরা। শুধু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই নয়, বাংলাদেশে প্রবাসী বিদেশী অতিথিরাও আসেন উপভোগ করতে।

স্থানীয়রা জানান, এ অঞ্চলের ‘সবচেয়ে বড়’ ভাসমান হাট সদর উপজেলার ভীমরুলীতে, যা সারা দেশেই অনন্য। এছাড়াও পাশের পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির (নেছারাবাদ) আটঘর, কুড়িয়ানা, আতা, ঝালকাঠির মাদ্রা। এসবই পিরোজপুর সন্ধ্যা নদী থেকে বয়ে আসা একই খাল পাড়ে অবস্থিত। পেয়ারার রাজ্য নামে সারাদেশে পরিচিত এখানকার আঁকাবাঁকা খালের দুই পাড়ে হাজার হাজার একর জমিতে রয়েছে পেয়ারা বাগান।

তাই ভীমরুলী পেয়ারার ভাসমান হাটে পাকা পেয়ারার সমারোহে এখন সর্বত্রই ম ম গন্ধ। এপ্রিল ও মে মাসের শুরুতে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি না হওয়ায় এবছর ফলন বিলম্ব হয়েছে। কয়েকদিন ধরে বাজারে পেয়ারা আসতে শুরু করেছে।

ভীমরুলী এলাকার পেয়ারা চাষী গৌতম মিস্ত্রি জানান, আমরা কয়েক পুরুষ পেয়ারা চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করি। প্রতিবছরের চেয়ে এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন আমরাও পেয়ার ন্যায্য দাম পাচ্ছি। আগের পাইকারদের দ্বারে দ্বারে ন্যায্য দামের আশায় ঘুরতে হতো। আর এখন পাইকাররাই আগ্রহী হয়ে আমাদের ডেকে পেয়ারা কিনছেন।

পেয়ারা রাজ্য ও ভাসমান হাট দুই শতাধিক বছরের ঐতিহ্য বলে জানান চাষিরা। তাঁদের তথ্যমতে, পেয়ারার ভরা মৌসুম চলছে। পেয়ারা বেচাকেনার পাশাপাশি যথারীতি সারাদেশ থেকে পর্যটকরা আসছেন পেয়ারা বাগান ভ্রমণে। ফলে আগামী তিন মাস পেয়ারা মৌসুমে দারুণ চাঙ্গা থাকবে এখানকার অর্থনীতি।

মাহমুদকাঠি গ্রামের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী আবুল বাশার বলেন, তিনি স্বাধীনতার পরপরই ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে পেয়ারা ব্যবসায় জড়িয়েছেন। সে হিসাবে তাঁর ব্যবসার বয়স অর্ধশত বছর পেরিয়েছে। পাইকারি দরে পেয়ারা কিনে তিনি ঢাকায় পাঠান।
তিনি বলেন, ৬০-৭০ দশকে ঢাকায় পেয়ারা পাঠানো হতো লঞ্চে। আশির দশকে ঝালকাঠি থেকে স্টিমারে তুলে দেওয়া হতো পেয়ারা। নব্বই দশকে বানারীপাড়ার জম্বুদ্বীপ থেকে প্রতিদিন দু-চারটি পিকআপে ঢাকায় পেয়ারা পাঠানো শুরু হয়। পরে ২০১৬ সালে মিনিট্রাক এবং ২০১৯ সাল থেকে বড় ট্রাকের ব্যবহার শুরু হয়।

এখানকার আড়তদারদের মতে, লঞ্চ-ট্রাক যে পথেই পাঠানো হোক, ঢাকার ভোক্তাদের কাছে পেয়ারা পৌঁছাত এক দিন পরে। দ্রুত পচনশীল পণ্য হওয়ায় এ সময়ের মধ্যে পেয়ারার রং-স্বাদ নষ্ট হতো। পেকে পচে যেত অর্ধেক পেয়ারা। এতে চাষিরা ন্যায্য দাম পেতেন না। পদ্মা সেতুর কল্যাণে এখন সকালে গাছ থেকে সংগৃহীত পেয়ারা দুপুরের আগেই পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকায়। এতে রং-স্বাদ দুটিই থাকছে অটুট।

পেয়ারার পাইকারি বেচাকেনার অন্যতম মোকাম ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলি ভাসমান বাজার। পেয়ারার মূল রাজ্য এই গ্রামটি। ঢাকার ব্যবসায়ী অপূর্ব মিস্ত্রী ভীমরুলিতে এসেছেন পেয়ারা কিনতে। তিনি বলেন, প্রতি কেজি পেয়ারা কিনেছেন ১৮/২০ টাকা দরে, যা ঢাকা ও খুলনায় ৪০ টাকা কেজি দরে আড়তে প্রদানের মূল্য হলেও খুচরা ক্রেতাদের কাছে ৫০টাকা বিক্রি করতে পারছেন। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ফলটির বাজারজাত সহজ হওয়ায় কৃষক ও আড়তদার দু'পক্ষই লাভবান হচ্ছেন।

ভীমরুলির চাষি সুদেব হালদার জানান, তিনি ৫০ একর জমিতে পেয়ারা বাগান করেছেন। ফলনের পুরোটাই ঢাকায় পাঠাবেন। ২০ টাকা কেজি দর পেলেই তিনি খুশি।

প্রবীণ চাষি বঙ্কিম চন্দ্র মন্ডল জানান, প্রায় ২০০ বছর আগে ব্রাহ্মণকাঠি গ্রামের কালীচরণ মজুমদার প্রথম এই অঞ্চলে পেয়ারা আবাদ করেন। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে তা ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশা, গাভারামচন্দ্রপুর, নবগ্রাম, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি ও বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলায়ও এখন কয়েক হাজার একর জমিতে পেয়ারার আবাদ হয়।

ঝালকাঠি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুলতানা আফরোজ জানান, তাঁর এলাকায় ১২০ হেক্টর জমিতে পেয়ারা বাগান রয়েছে। এ বছর প্রতি হেক্টরে ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ১০ টন।
চাষিরা তাঁকে জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর কারণে সরাসরি ঢাকায় পেয়ারা যাওয়ায় এবার দাম বেশি পাচ্ছেন। এ বছর ১৫ থেকে ২০ দিন বিলম্বে ফলন ধরায় পেয়ারার ভরা মৌসুম এখন চলছে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন আমরা
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, এ সেতুর প্রভাবে ঝালকাঠিতে কৃষি বিপ্লবের বিস্ফোরণ ঘটবে। কৃষক ও কৃষির উন্নয়ন তরান্বিত হবে। এর ফলে দ্রুত কৃষকের উৎপাদিত পণ্য দেশের সব বাজারে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। ফেরীর অপেক্ষায় কৃষি পণ্য নষ্ট ও সময় ক্ষেপন হচ্ছে না। কৃষকের নগদ ও ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। বাকিতে পাইকারের কাছে বিক্রি করতে হবেনা। বিশেষ করে সবজি, আমড়া ও পেয়ারার বাজার তরান্বিত হয়েছে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন আমরা
জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী জানান, ঝালকাঠির ব্রান্ড পণ্য পেয়ারা ও শীতলপাটি চাষীদের এতো দিনের স্বপ্ন পূরণের দ্বার উম্মোচন হয়েছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। কারণ বিশ্বের সকল পর্যটকরা এখন সরাসরি ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে ঝালকাঠি এসে পেয়ারা রাজ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে। একই সাথে সরাসরি ন্যায্য মূল্যে বেশি করে কিনে নিতে পারবে ঝালকাঠি পাটিকরদের হাতে তৈরী শীতলপাটি। সেই সাথে পদ্মা সেতুর প্রভাবে এ জেলায় ঘটে যাবে কৃষি বিপ্লব। সেতুর কারণে চাহিদা অনুযায়ী জেলার কৃষি পণ্য বিশেষ করে সবজি দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকায় সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

গরম খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram