পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনতে ঘোষণা আসছে
ডেস্ক রিপোর্টঃ দেশ থেকে যে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হয়, এত দিন সরকারের পক্ষ থেকে তা স্বীকারই করা হচ্ছিলো না। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে সরকারই এখন পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার পথ খুঁজতে শুরু করেছে। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে ৯ জুন। এ বাজেটের আগেই সরকার এ বিষয়ে নতুন ঘোষণা দিতে পারে বলে জানা গেছে। মূলত বিদেশ থেকে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে চায় সরকার। এ জন্য আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ যেসব বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করেছেন, নামমাত্র কর দিয়ে সেগুলো দেশে ফিরিয়ে আনাই সরকারের উদ্দেশ্য।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে বাজেটের আগেই পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে বলে আভাস দেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। কানাডার বেগমপাড়া বা পশ্চিমবঙ্গে বন্দী প্রশান্ত কুমার হালদারদের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা হবে। যদি কেউ নিজ উদ্যোগে ফেরত নিয়ে আসেন তো ভালো। তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না। অর্থ ফেরত আনার করও ধরা হবে ন্যূনতম।
পাচার হওয়া অর্থ এভাবে ফেরত আনতে গেলে নতুন নতুন পাচারকারী তৈরি হতে পারে এবং অবৈধভাবে অর্জন করা অর্থ বিদেশে পাঠিয়ে পরে দেশে এনে বৈধ করার প্রবণতাও তৈরি হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থ আগে দেশে ফেরত আসা দরকার। সেভাবে আমরা এগোচ্ছি।
জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি, স্পেন, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশ যেভাবে তাদের দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কৌশল অবলম্বন করছে, বাংলাদেশও সে পথে এগোচ্ছে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে বলে জানা গেছে। পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার একটি কৌশল হচ্ছে সম্পদ বিদেশে রেখেই তাদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করা। এটি হচ্ছে বাড়ি-গাড়ির মতো স্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে। অন্যটি হচ্ছে নগদ অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে। বিদেশে ইতোমধ্যে যারা সম্পদ গড়েছেন, আয়কর রিটার্নে তারা তা দেখাতে পারবেন। এ জন্য তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না। তবে কর দিতে হবে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা।
একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, আরেক দিকে ডলারের বিপরীতে মান কমছে টাকার। সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যয় সাশ্রয় করতে সরকার ইতোমধ্যে বিলাসদ্রব্য আমদানিতে লাগাম টেনেছে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণেও। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে না বলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
এমনই যখন পরিস্থিতি, অতি কাছেই তখন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুরোদমে কাজ করছে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে। প্রাথমিকভাবে ৬ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েও বাজেটের আকার শেষ পর্যন্ত কয়েক হাজার কোটি টাকা কমিয়ে আনার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বাজেট প্রণয়নে সরকার এবার সতর্ক।
বাজেটে ব্যয় যা করার তো করতেই হবে। যেমন সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতেই ব্যয় হবে প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। এযাবৎ দেশি-বিদেশি যত ঋণ নেয়া হয়েছে, তার বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে হবে ৮০ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ, সার ও রফতানি ভর্তুকি; প্রণোদনা এবং নগদ ঋণে ব্যয় হবে আরো পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরটি চালাতে সরকার এ ছাড়া ঋণ নেবে এবার বেশি। তাও প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। আর সরকার আশা করছে, আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্ব পাওয়া যাবে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে এনবিআরের দায়িত্ব থাকবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের লক্ষ্য ছিলো ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা। ৯ মাসের প্রবণতা বিবেচনায় নিয়ে এনবিআরের কর্মকর্তারা আশা করছেন, অন্তত ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।
অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে বলেন, আগামী বাজেটে বড় ঘাটতিই থাকবে। ঋণও করা হবে ভালোই। কারণ, সবার চাহিদা মেটাতে গিয়ে তা করতে হবে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য হিসেবে ব্যতিক্রম ছাড়া আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কিন্তু ডলারের দাম ও সরবরাহ এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে অত্যাবশ্যক নয় এমন অন্তত ১৩৫টি পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে গত মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এনবিআর। প্রসাধনী, ফুল, ফল, আসবাব ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ছিল যেখানে শূন্য থেকে ৩ শতাংশ, বাড়িয়ে তা ২০ শতাংশ পর্যন্ত করা হয়েছে।
ডলারের আনুষ্ঠানিক বিনিময় মূল্য এখন ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা। যদিও খোলা বাজারে এর দাম ১০০ টাকার মতো। ১৯ মের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এখন ৪ হাজার ২৩২ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অথচ ৯ মাস আগেও তা ছিলো ৪ হাজার ৮১০ কোটি ডলার।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আমদানির জন্য পরিশোধিত অর্থের পরিমাণ ছিলো ৬ হাজার ১৫০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৪৪ শতাংশ বেশি। ডলার সাশ্রয় করতেই সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।