২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
shadhin kanto

শিক্ষিত শারীরিক প্রতিবন্ধী শাহাদাত, দয়া নয় চাকরি চান

প্রতিনিধি :
স্বাধীন কণ্ঠ
আপডেট :
জানুয়ারি ১২, ২০২১
31
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
শিক্ষিত-প্রতিবন্ধী-শাহাদাত-চাকরি চান
অসহায় শিক্ষিত শারীরিক প্রতিবন্ধী শাহাদাত, দয়া নয় চাকরি চান | ছবি : শিক্ষিত-প্রতিবন্ধী-শাহাদাত-চাকরি চান

আবদুল্লাহ আল মামুন,(যশোর)মনিরামপুর প্রতিনিধি: লাঠি নিয়ে এক পায়ে ভর করে স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করেছি, বন্ধু-বান্ধব আর সমাজের কিছু উদার মনের অধিকারী মানুষের সহায়তা নিয়ে স্নাতক পড়াশুনা শেষ করেছি এবং শত অভাব অনাটন আর চলাচলের কষ্টের মধ্যেও সম্মানজনক ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।

যুব উন্নয়নসহ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষন গ্রহণ করেছি।

কিন্ত একটা চাকুরী আমার ভাগ্যে জুটলো না। সৃষ্টিকর্তা আমাকে প্রতিবন্ধী করে সৃষ্টি করেছেন-এটাই কি আমার অপরাধ? আমি কি পরিবারের বোঝা হয়েই থাকবো আজীবন?-এমনই আক্ষেপ নিয়ে কথা গুলো বলছিলেন মণিরামপুরের  স্নাতক ডিগ্রীধারী প্রতিবন্ধী যুবক শাহাদাত হোসাইন।

উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের মাছনা গ্রামের ভুমিহীন-হতদরিদ্র শরিয়াতুল্লাহ ফারাসের ছেলে শাহাদাত। পিতা-মাতার ৫ সন্তানের মধ্যে সে ৪র্থ সন্তান। বয়স ২৭ বছর।

সাংবাদিকদের কাছে শাহাদাত মনের আবেগ জড়িত কন্ঠে আরও বলেন, আমার একটা পা বিকলঙ্গ। তবুও লাঠির সাহায্য নিয়ে অফিসের ৪/৫তলার সিঁড়ি বেয়ে উঠেও অফিসিয়াল কাজ করতে পারবো। আমাকে কেউ একটা চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেন। সরকারী না হোক-খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারি এমন একটা সাধারণ চাকুরী হলেও আমি মনে করি সোনার হরিণ হাতে পাবো। কারো অনুকম্পা নয়-আমি নিজে কাজ করে সম্মনের সহিত বাঁচতে চাই। পরিবারের হাল ধরতে চাই। শারীরিক প্রতিবন্ধিত্বকে জয় করে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেও বেকার মেধাবী শাহাদাত হোসাইন এভাবেই আকুতি জানিয়েছেন সাংবাদিকদের কাছে।

খোজখবর নিয়ে জানা যায়, পৌরশহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দুরে মাছনা গ্রামের মধ্য পাড়ায় শাহাদাতের বাড়ী। এ গ্রামের ব্র্যাক স্কুলে তার হাতে খড়ি। কিন্তু প্রতিবন্ধী হওয়ায় সে স্কুলে তার বেশিদিন যাওয়া হয়নি। শিশু শাহাদাতের পড়ালেখার প্রতি উৎসাহ দেখে তার মা তাকে বাড়ী থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার দুরে মাছনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন।

মায়ের কোলে চড়ে সে স্কুলে যেতো
কিন্তু অস্বচ্চলতার কারণে তার মায়ের প্রতিদিন শাহাদাতকে নিয়ে যাওয়া হয়ে উঠতো না। কিন্তু শাহাদাত হাল ছাড়ার পাত্র নয়। কাউকে না জানিয়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে এবং মাঝে মাঝে লাঠির সাহায্য নিয়ে স্কুলে গিয়ে হাজির হতো।

এভাবে সে গ্রামের ওই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ভাল ফলাফল নিয়ে সে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে। কিন্তু বিধি বাম বাড়ীর কাছে আর কোন মাধ্যমিক স্কুল না থাকায় তার পিতা তাকে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করাতে পারেনি। অভাবের তাড়নায় তার বাবা তাকে মাছনা গ্রামের বাবর আলী গাজীর বাড়ীতে কাজের জন্য রেখে দেই। লেখাপড়া ছেড়ে সে ওই বাড়ীতে পেটে-ভাতে কাজ থাকে। কিন্তু ওই বাড়ীর সন্তানেরা যখন স্কুলে যায়-শাহাদাত তখন ফ্যাল ফ্যাল করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ বিষয়টি শাহাদাতের মনিব বাবর আলী খেয়াল করেন। তিনি শাহাদাতের কাছে জানতে চান কেন তার মন সব সময়ে আনমনা হয়ে থাকে। সুযোগ পেয়ে শাহাদাত তার মনে কথা ব্যক্ত করে বলে আমিও স্কুলে যেতে চাই।

শাহাদাতরে স্কুলে যাবার আগ্রহ দেখে তার মনিব বাবর আলী স্কুলে যাবার অনুমোতি প্রদান করেন
 শাহাদাতের আবার নুতন জীবন শুরু হলো। ভর্তির জন্য সে কামালপুর মাদরাসায় গেলো। মাদরাসার সুপার মাওলানা মুনসুর হোসেন তার মেধা যাচাই করে ৭ম শ্রেণিতে ভতি করে নেন। কিন্তু প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাকে অনেক বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। কিন্তু শত বিড়ম্বনার মধ্যেও হাল ছাড়েনি-বরং পড়ালেখার জন্য আরো জেদ চাপে তার। তার ইচ্ছা সে লেখাপড়া শিখে সমাজের একজন হতে চাই।

ওই বাড়ী থেকে কাজের ফাকে-ফাকে সে পড়ালেখা ও স্কুল চালিয়ে যেতে থাকে। ১০ বছর ওই বাড়ী থেকে সে কামালপুর সিদ্দিকীয়া দাখিল মাদরাসা থেকে দাখিল (এসএসসি) পাশ করে।

২০০৯ সালে কামালপুর সিদ্দিকীয় দাখিল মাদরাসা দাখিল (এসএসসি), ২০১১ সালে বাহিরঘরিয়া-গোপালপুর আলিম মাদরাসা থেকে আলিম এবং পরবর্তীতে মণিরামপুর ফাজিল (বি,এ)) মাদরাসা থেকে ফাজিল স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন।

এছাড়া কম্পিউটার বিষয়ে এমএসওয়ার্ড, এক্সএলসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ তিনি। উচ্চ শিক্ষালাভ করায় ইচ্ছা থাকলেও মারাত্মক অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে সেটা আর হয়ে উঠেনি। অনেক চেষ্টা আর তদবীরের বিনিময়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে জুটে শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড। প্রতিমাসে পাচ্ছে ৭৫০ টাকার আর্থিক সহায়তা।

শাহাদাত বলেন, বর্তমানে ইসলামী ফাউন্ডেশনের মসজিদ ভিত্তিক গণশিক্ষা কার্যক্রমের শিক্ষক হিসেবে মধ্য মাছনা জামে মসজিদের শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষাকতা করলেও সেটাও আপাতত বন্ধ রয়েছে।

বাবা-মায়ের বোঝা হয়ে আর থাকতে চান না তিনি

বর্তমানে মণিরামপুর পৌরশহরের তার বন্ধু বিল্লাল হোসেনের ফুলের দোকানে সহায়তার পাশাপাশি একটি চাকুরীর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু বাবা-মায়ের বোঝা হয়ে আর থাকতে চান না তিনি। একটা চাকরি পেলে তিনি পরিবারের হাল ধরতে চান।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের মাত্র ২বছর সময় আছে তার
একটা চাকুরীর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সমাজের বিত্তবানসহ সবার কাছেই আকুল আকুতি জানিয়েছেন শাহাদাত হোসাইন। সরকারী না হোক-অন্তত সম্মানের সহিত বেঁচে থাকার জন্য যেকোন একটা সাধারণ চাকুরী হলেও-সেটা বড় পাওয়া হবে তার জন্য।

শাহাদাতের পিতা-মাতা তাকে নিয়ে খুবই চিন্তিত
তারা বলেন, ওর জন্য আমরা কিছুই করতে পারি নাই। যা কিছু অর্জন করেছে কিছু ভাল মানুষের সহায়তা নিয়ে ও নিজের চেষ্টায় এতদুর আসতে সক্ষম হয়েছে। পড়ালেখার জন্য অনেক কষ্ট করেছে ও। সবার বকুনি আর মানুষের তুচ্ছকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে এ পর্যন্ত আসতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিদিন মাছনা থেকে মণিরমাপুর পৌরশহরে আসতে তার অনেক কষ্ট হয়। মাঝে-মাঝে এমনই হয় যে বাড়ী আসতে তার অনেক রাত হয়ে যায়। কারণ সে যখন আসে তখন বাড়ী ফেরার মত কোন ভ্যানগাড়ী রাস্তায় থাকে না। এখনতো প্রতিবন্ধীদের জন্য স্বল্প খরচে বিভিন্ন রকমের ব্যাটারি চালিত গাড়ী বের হয়েছে-যদি কোন ভাবে একটা গাড়ী ওকে কিনে দিতে পারতাম তবুও ওর কষ্ট কিছুটা কম হতো।

শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করি-হে আল্লাহ আমাদের প্রতিবন্ধী ছেলেটার একটা চাকুরী দাও। ওর একটা চাকুরী হয়েছে এটা যদি দেখে যেতে পারি তাহলে মরেও শান্তি পাবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

গরম খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram