৩০ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন মুখে দাড়ি নিয়ে রুমা বেগম
ডেস্ক রিপোর্টঃ মুখে লম্বা দাড়ি,কোনোটা কাঁচা আবার কোনোটা পাকা। পরিচর্যায়ও করেন নিয়মিত। মুখে দাড়ির কারণে ৩০ বছর অন্যদের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন ঝিনাইদহের সদর উপজেলার সোনাদাহের গোয়ালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ৬১ বছর বয়সী সুফিয়া বেগম। প্রয়োজন ছাড়া তিনি বের হন না বাড়ি থেকে। যদিও বের হন মুখ ঢেকে। পরিবার পরিজন বলতে বোন ও বোনের সন্তানরা ছাড়া কেউই নেই তার।
বিয়ের পর সন্তান হলেও জন্মের পরই মারা যান। কিছুদিন পর স্বামীও মারা যান। খুবই কষ্টের জীবন পার করতে হয়েছে তাকে। এখন সব মেনে নিয়ে শেষ বয়সে একটি মুরগির ফার্মে কাজ নিয়েছেন। সেখান থেকে যা পান তা দিয়েই চলেন। অবসর সময়ে কাঁথা সেলাই, এলাকার নারীদের কোরআন শিক্ষা দেন।
সুফিয়া বেগম ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সোনাদাহের গোয়ালপাড়া গ্রামের মৃত হবিবার জমাদ্দারের মেয়ে। তিনি বর্তমানে ঝিনাইদহ পৌরসভার পবহাটি গ্রামে থাকেন।
সুফিয়া বেগম বলেন, ‘আমরা চার বোন এক ভাই। বাবা মারা গেছেন ছোটবেলায়। বড় হয়েছি মামার বাড়িতে। ১২ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর একটি সন্তান হয়। সন্তানটি জন্মের পরই মারা যায়। কয়েক বছর পর স্বামীও মারা যায়। ১০ বছর পর মামারা আবারো দ্বিতীয় বিয়ে দেয়। সেই স্বামীও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তারপর আর বিয়ে করা হয়নি। সব হারিয়ে বোনদের বাড়িতে, বোনের মেয়েদের বাড়িতে থাকি। ছোট থেকেই জীবনে অনেক কষ্ট, সব সময় আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করি।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে পেটে টিউমার হলে ঝিনাইদহের হাসান ক্লিনিকে অপারেশন করা হয়। বাড়ি ফেরার কিছুদিন পর আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করার পর রাতে ঘুমালে হঠাৎ স্বপ্ন দেখি একটা হুজুর স্বপ্নে আমাকে বলছে, তোর মুখে দাড়ি উঠবে, তুই কাউকে বলবি না। বোনের বাড়ির পাশে একটি আম গাছ দেখিয়ে বলে- তুই ওই আম গাছের গোড়ায় চারিদিক কাপড় টাঙিয়ে ওখানেই থাকবি। সমস্যায় পড়ে কোনো মানুষ আসলে কলসিতে পানি পড়ে রাখবি, সেই পড়া পানি রোগীদের দিবি, তাদের রোগ ভালো হয়ে যাবে। তোর হাতের জয় হবে। তখন আমি বলি- আমার কোনো সন্তান নেই, স্বামী নেই, কোনো টাকা-পয়সাও নেই, পরের বাড়ি থাকি। আমি যদি ওখানে থাকি তাহলে কে আমাকে টাকা-পয়সা দেবে, খেতে দেবে।’
‘তখন হুজুর বলে- তুই ওখানে থাকবি। আল্লাহই তোর খাবারের ব্যবস্থা করে দেবে। এই বলে আমাকে দোয়া শিখিয়ে দিয়ে যায় এবং বালিশের পাশে এক বান্ডিল টাকা রেখে যায়। হুজুর সতর্ক করে বলে এই কথা কাউকে না বলতে। পর দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার মুখে দাড়ি। সত্যি সত্যি আমার মুখে দাড়ি উঠেছে। তখন আমি বাহিরে এসে বোনের মেয়েদের বলি এই তোরা দেখ আমার মুখে দাড়ি উঠেছে। তখন ওরা এসে দেখে সত্যিই আমার মুখে দাড়ি। তখন ওদের কাছে হুজুরের দেওয়া টাকার কথাও বলি। ওদের সাথে টাকার কথা বলে ঘরের ভেতর টাকা আনতে গিয়ে দেখি, বালিশের পাশে যে টাকা রেখে গেছি সেই টাকা আর নেই। তখন আমার হুজুরের কথা মনো হলো হুজুর এই কথা কাউকে বলতে নিষেধ করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘মুখে দাড়ি নিয়ে আমি কোথাও যেতে পারতাম না। যার কারণে দাড়ি উঠলে কেটে ফেলতাম। কোথাও যেতাম না। বাড়িতে থাকলেও ঘর থেকে কম বের হতাম। কোথাও গেলে সব সময় মুখ লুকিয়ে থাকতাম। এরপর ভাই মারা যাওয়ার কিছু দিন পর আমার স্ট্রোক হয়। এক মাস ১০ দিন কথা বলতে পারিনি। হাত পা মেলাতে পারিনি। তখন বোনের মেয়ে হাত ধরে শপথ করালো আমি যেন আর কোনো দিন দাড়ি না কাটি। তারপর থেকেই সুস্থ। এখন বয়স হয়ে গেছে। দেখার কেউ নেই। এখন আর মুখ বেঁধে থাকতে পারি না। তাই এখন মুখে দাড়ি নিয়েই বের হতে হয়। বোনের মেয়েরা দেখাশোনা করে।’
সুফিয়া বেগম বলেন, ‘এক সময় প্রচুর কান্নাকাটি করেছি, এখন সব মেনে নিয়েছি। বাড়ি থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হই না। জীবনে সব কিছু হারিয়ে শেষ বয়সে একটি মুরগির ফার্মে কাজ করি। এখান থেকে যা পাই তা দিয়েই চলে। অবসর সময়ে কাঁথা সেলাই, এলাকার নারীদের কোরআন শিক্ষা দেই। বোনের মেয়ে একটা প্রতিবন্ধী ভাতা করে দিয়েছে। তাছাড়া আর কোনো সহযোগিতা পাই না। শেষ বয়সে এসে যদি কেউ আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতো, তাহলে হয়তো নিজের একটা নিরাপদ ঘর করে সেখানেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম।’